আজ শনিবার, ১৩ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মাদকের জোয়ারে ভাসছে নারায়ণগঞ্জ

মাদকের জোয়ারে

 

মাদকের জোয়ারে

রুদ্র প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জ:
মাদকের জোয়ারে ভাসছে নারায়ণগঞ্জ। প্রায় প্রত্যেকটি পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠেছে একাধিক মাদক স্পট। ধীরে ধীরে মাদকের করাল গ্রাসের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে বহু মাদকাশক্ত নিরাময় কেন্দ্রও। আবাসিক হোটেলগুলোতেও এখন মাদক ব্যবসা চলছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রত্যেক মাদক স্পট থেকেই থানা-পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা মাসোহারা নিচ্ছে। মূলত দেশের মাদক ব্যবসার অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা। ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগস্থল হল মাদকের অন্যতম বর্ডার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রুটে মাদকের বিপুল পরিমাণ চালান প্রবেশ করছে মায়নামারের ইয়াবা। ফেন্সিডিলের সবচেয়ে বড় চালানগুলো আসছে কুমিল্লা থেকে। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা ফেন্সিডিল বিভিন্ন কৌশলে ট্রাক অথবা বাসযোগে পৌঁছে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। এছাড়াও ঢাকার আমিন বাজার, গেন্ডারিয়া, কমলাপুর, শ্যামপুর ও আশপাশের এলাকা থেকেও মাদকের ছোট-বড় চালান প্রবেশ করছে নারায়ণগঞ্জে। পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সিগঞ্জ থেকেও চালান আসছে এবং নারায়ণগঞ্জ থেকেও মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাদক পৌঁছে যাচ্ছে।

জানা গেছে, শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতেই প্রায় তিন শতাধিক মাদক স্পট রয়েছে। শহরের খানপুর, নগর খানপুর, হাজীগঞ্জ, তল্লা, ব্যাংক কলোনী, মাছুয়াপাড়া, আমলাপাড়া, নন্দীপাড়া, জামতলা, ধোপাপট্টি, পালপাড়া, ৫নং ঘাট, টানবাজার থানাপুকুরপাড়, বৌ-বাজার, বাবুরাইল, নয়াপাড়া, জল¬ারপাড়া, জিমখানা, নতুন জিমখানা, সূতারপাড়া, নিতাইগঞ্জ, নয়ামাটি, বালুরমাঠ, শহরের শহীদ মিনার এলাকা, ফতুল্লার কুতুবাইল, রেললাইন, কাঠেরপুল, পৌষার পুকুরপাড়, দেওভোগ, শিবু মার্কেট, নতুন ষ্টেডিয়াম এলাকা, বাড়ৈভোগ, মাসদাইর, ইসদাইর, সস্তাপুর, পুলিশ লাইন, গাবতলীসহ প্রায় প্রত্যেক মহল্লায় এখন হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যাচ্ছে। এসব এলাকার পাশাপাশি ফতুল্লার বিশাল বিসিক শিল্প এলাকাতেও মাদকের ব্যবসা চলছে। প্রকাশিত সংবাদের তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলো জমজমাট ব্যবসা করছে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশই যুবক এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মাদকাশক্ত নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক জানান, মূলত একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা নিরাময় কেন্দ্র খুলেছিলাম। কিন্তু মাদকের পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, কেন্দ্রগুলো এখন ব্যবসায়িক চিন্তাধারায় গড়ে উঠছে। তাদের অভিমত, নারায়ণগঞ্জের মাদকের অবস্থা এখন ভয়াবহ।

জেলার একটি গোয়েন্দা সংস্থার হিসেবে নারায়ণগঞ্জে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি বিক্রেতা ও বহনকারী। পুলিশের তালিকায় প্রায় অর্ধশত বড় ডিলারের নাম থাকলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। যদিও নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান নির্বাচিত হবার পর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করে আসছেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তার বক্তব্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে থাকছে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা কমিটির এক সভায় তিনি দাবি করেন, পুলিশ, মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা যদি শক্তিশালীভাবে কাজ করে তাহলে আগামী ৭ দিনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে কোন মাদক থাকবে না। প্রয়োজনে মাদক ও সন্ত্রাস রুখতে পুলিশদের গুলি করারও পরামর্শ দেন এই সাংসদ। একই সভায় ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শওকত আলী ‘মাদক ব্যবসায়ীরা আমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী’ বলে মন্তব্য করেন।

এছাড়াও রাইফেল ক্লাবে গত বছরের ঈদুল আজহার আগে একটি সভায় শামীম ওসমান মাদক ব্যবসায়ীদের কোরবানী দেবার ঘোষণাও দেন। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো: মঈনুল হক জানিয়েছেন মাদকের ব্যাপারে পুলিশের অবস্থান জিরো টলারেন্স। এ বিষয়ে কোন আপোষ নেই।

প্রায় একই চিত্র সারাদেশেও
এদিকে সারাদেশে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতি মিনিটে ৩৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার করছেন। মাদকের ভয়াবহ প্রকোপ বিশেষ করে ইয়াবার ভয়াবহ চিত্রে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বেকায়দায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১৪ সালে ৬৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৯ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ২০১৫ সালে উদ্ধারকৃত ইয়াবার পরিমাণ তিনগুণের বেশি অর্থাৎ ২ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার ৪৫ পিস। একই সময় ফেনসিডিল, কোকেনসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধারের পরিমাণও কমেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খাতায় ২০১৫ সালে আফিম উদ্ধারের পরিমাণ শূন্য। ২০১৪ সালে উদ্ধাররকৃত আফিমের পরিমাণ ছিল ৯১ কেজি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও পাচার বন্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখে হালনাগাদ ও যুগোপযোগী আইন করা হবে। দেশে ৫০ হাজারেরও বেশি মামলা পেন্ডিং রয়েছে। এজন্য পৃথক আদালত গঠনের কাজ চলছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে সারা দেশে ৫১ হাজার ৮২৭টি মামলায় ৬২ হাজার ২৪৬ জনকে আসামি করা হয়। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা ৫৭ হাজার ৪২৭টি ও আসামির সংখ্যা ৭০ হাজার ৫৯০ জনে দাঁড়িয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ১১ হাজার ৭২৩টি ও ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫৪৮টি মামলা দায়ের করা হয়। সূত্র আরও জানায়, ২০১৪ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৪ হাজার ৮১৫টি অভিযানে ৭ হাজার ৯৪৮টি মামলায় ১২ হাজার ৫৯০ জনের সাজা ও ২০১৫ সালে ১৪ হাজার ৯৩৭টি অভিযানে ৭ হাজার ৪৮৭টি মামলায় ৭ হাজার ৮২৩ জনকে সাজা দেয়া হয়।

মহামারীরূপে ইয়াবা
অন্যদিকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সীমান্ত হয়ে প্রতি মাসে প্রায় পৌনে দুই কোটি পিস নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য দুইশ’ কোটি টাকারও বেশি। ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও শ্রমজীবীসহ প্রায় সব শ্রেণীর মানুষই ইয়াবার নীল বিষে আক্রান্ত। আর এ অবৈধ ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত সীমান্তের শীর্ষ ৬৯ ইয়াবা ব্যবসায়ী যথারীতি থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মিয়ানমার থেকে যে সংখ্যক ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে, এর ২০ ভাগের মাত্র একভাগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ছে। শত শত কোটি টাকা মূল্যের বাকি সব ইয়াবা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

সূত্র জানায়, ইয়াবা হচ্ছে থাই শব্দ। যারা অর্থ হচ্ছে ক্রেজি ট্যাবলেট। ‘ইয়া’ অর্থ ক্রেজি, আর ‘বা’ মানে হচ্ছে ট্যাবলেট। ইয়াবা হচ্ছে ব্র্যান্ড নেম। ইয়াবা হলো মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ। মাদকটি একাধারে মস্তিষ্ক ও হƒদযন্ত্র আক্রমণ করে। এই মাদক সেবন করলে মস্তিষ্কে একধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। এরপর আসে মানসিক অবসাদ। ঘুম হয় না। আচরণে ও চিন্তায় বৈকল্য দেখা দেয়। ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়। মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে যে ইয়াবা আসছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আর-৭। এই আর-৭ এর অন্তত ১০টি ক্যাটাগরির ইয়াবা এখন বাজারে অহরহ মিলছে। এমনকি, পান দোকান, ফুটপাতের চা দোকান, এমনকি যারা হেঁটে চা বিক্রি করছে তাদের কাছেও পাওয়া যাবে। সূত্রটি জানায়, আর-৭ এর এক নম্বর ক্যাটাগরির এক পিস ইয়াবার মূল্য প্রায় দুই হাজার টাকা। এর সর্বনি¤œ যে মূল্য রয়েছে তার এক পিস চারশ’ টাকা। সূত্র জানায়, বাজারের সবচেয়ে সহজলভ্য ইয়াবার নাম ‘চম্পা’। এর রং গাঢ় লাল। এটির বাজারমূল্য প্রতিপিস দেড়শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকার মতো।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ইয়াবা মূলত প্রবেশ করে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার অন্তত ৪৫টি রুট দিয়ে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত জনপদ কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ইয়াবার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর প্রবেশ ও ব্যবহার কোনো ক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। ইয়াবার প্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। শুধু বাংলাদেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মিয়ানমারে স্থাপিত হয়েছে ৭টি ইয়াবা কারখানা। এছাড়া মিয়ানমারের মংদু শহরে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে বলে সূত্র জানায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মাদক চোরাকারবারি সিন্ডিকেট মিয়ানমারের ওয়া আর্মি নামের সংগঠনের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে এসব ইয়াবা। প্রতিদিন এ ৭টি কারখানায় ১০ লাখেরও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট উৎপাদন করা হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্ত গলে চোরাইপথে এসব ইয়াবা আসছে টেকনাফে। সেখান থেকে আসছে কক্সবাজারে। আর এসব চালান সংগ্রহ করছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়াসহ পাশের এলাকার কিছু প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অল্প বয়সী শিশু কিশোররা মরণ নেশা ইয়াবা আসক্ত হওয়ার কারণে যে কোনো সময় তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে লিভার, কিডনি ও পাকস্থলী। অপ্রাপ্ত বয়সে মাদকাসক্ত শিশুর ক্ষেত্রে বিষণœতা দেখা দিতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে সমাজ জীবনে নিজেকে আড়াল করার প্রবণতা। ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় এতে আত্মহত্যার প্রবণতা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রথম ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকা করা হয়। ওই তালিকায় নাম ছিল ৫৫৪ জনের। সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ তালিকা তৈরি করেছে। এতে এবার ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫শ’র বেশি। কিন্তু তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে ইয়াবা পাচার প্রতিরোধ করা অনেক সময় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।